তাসলিমা ইয়াসমীন: গত কয়েক দিনে ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদের ফলস্বরূপ আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার বিষয়টি শিগগিরই মন্ত্রিসভায় বিবেচনা করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে না এটি সন্দেহাতীত, তবে তারপরও এই ধরনের সিদ্ধান্ত হয়তো কিছু সময়ের জন্য হলেও জনমনে স্বস্তি দিতে পারে। আর সে কারণেই খুব সম্ভবত দ্রুত সময়ের মধ্যে আইন সংশোধনের চিন্তা করা হচ্ছে। তবে সাময়িক ক্ষোভ স্তিমিত করা গেলেও ধর্ষণের অবস্থার যখন কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, তখন একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটবে। বরং রাষ্ট্রের উচিত হবে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে গণপ্রতিরোধ জেগেছে, তাকেই পুঁজি করে ধর্ষণ দমনে আর ধর্ষকের বিচারে একটি অর্থপূর্ণ আর কার্যকর পরিবর্তনের সূচনা করা। জনমতকে তাতে অন্তর্ভুক্ত করাও প্রয়োজন। ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করতে একটি অর্থপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল প্রয়াস রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনসমক্ষে পরিষ্কার করা হলে তা সরকারি নীতির প্রতি জনগণের আস্থাকে আরও দৃঢ় করবে।
মৃত্যুদণ্ড যোগ করলেই যে ধর্ষণের বিচারের অবস্থার উন্নতি হবে না বরং অবনতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, এই বিষয়টি সাধারণের জন্যও পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। সাধারণভাবে এই হিসাব কষলেই হবে যে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে যদি ধর্ষণ বন্ধ করা যেত, তবে ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত গত ২০ বছরে ধর্ষণ করে হত্যার যে অজস্র ঘটনা আমরা দেখেছি, তা ক্রমান্বয়ে কমে আসার কথা ছিল। কেননা ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ করে হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের তথ্যমতে, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন নারী, যার মধ্যে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে ৪৩ জনকে। সুতরাং ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আইনে করা গেলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যাবে না, বরং শাস্তির মাত্রাকে আরও কঠোর করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ধর্ষণের শিকার নারীই।
বর্তমান আইনেই ধর্ষণের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর, যেখানে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে বিচারক শুধু একটি শাস্তিই দিতে পারবেন, আর তা হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। একজন বিচারক যখন জানেন যে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই তাঁকে শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবনই দিতে হবে, স্বাভাবিকভাবেই তিনি দোষী প্রমাণিত করার আগে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হতে চাইবেন যে ধর্ষণের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এর প্রভাব পড়বে অপরাধের শিকার নারীর ওপরই। দেখা গেছে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ খুঁটিনাটি প্রমাণ করার বোঝা থাকে বাদীপক্ষের ওপর, তাতে শেষমেশ একজন দোষী ব্যক্তিও খালাস পেয়ে যান যথাযথ প্রমাণের অভাবে। ধর্ষকের তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড দাবি করার আগে তাই এই বিষয়গুলোও ভাবার দরকার। যদি শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডও যুক্ত হয়, তবে ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে একজন নারী স্বাভাবিক সময়ে যে পরিমাণ হেনস্তার শিকার হন, তা না কমলেও বরং বাড়তে পারে।
ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলেই ধর্ষণ কমে যেতে পারে ভেবে যাঁরা অতিমাত্রায় আশাবাদী, তাঁরা অনেক সময়ই বাংলাদেশে ২০০২ সালে করা অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনের উদাহরণ টানেন। সাধারণভাবে অনেকেই ধরে নেন যে আইনটিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলেই অ্যাসিড–সন্ত্রাস অনেকটাই কমে এসেছে। আদতে অ্যাসিড-সন্ত্রাস কমার পেছনে এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিষয়টি আসলে ভূমিকা রেখেছে কি না, সে ব্যাপারটি কিন্তু জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। কোনো গবেষণালব্ধ তথ্যও নেই যেখানে অ্যাসিড–সন্ত্রাস কমার পেছনে আইনে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডকেই সরাসরি কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
একজন বিচারক যখন জানেন যে ধর্ষণ প্রমাণিত হলেই তাঁকে শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবনই দিতে হবে, স্বাভাবিকভাবেই তিনি দোষী প্রমাণিত করার আগে ১০০ ভাগ নিশ্চিত হতে চাইবেন যে ধর্ষণের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এর প্রভাব পড়বে অপরাধের শিকার নারীর ওপরই।
বরং ২০১৫ সালের করা একটি গবেষণায় দেখেছিলাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে যে জটিলতা রয়েছে, অ্যাসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অবস্থাও অনেকটা একই রকম। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনিয়ম আর অদক্ষতার অভিযোগ, সাজার নিম্নহার, এই সবকিছুই একইভাবে বিদ্যমান। বরং সাম্প্রতিক কালের গবেষণাগুলো বলছে, অ্যাসিড অপরাধের মাত্রা কমে আসার সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ হতে পারে এটি যে এই অপরাধের শিকার ব্যক্তির ওপর অপরাধের ভয়াবহতা বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান, যা কিনা অপরাধের বিরুদ্ধে সমষ্টিগত সামাজিক অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
অন্যদিকে ধর্ষণ অপরাধটি এমন যে বাহ্যিকভাবে এর ভয়াবহতা যেমন প্রকাশ পায় না, অন্যদিকে নারী বা তার পরিবারই বিষয়টিকে অপমানজনক মনে করে অভিযোগ গোপন রাখার চেষ্টা করে। তাই আইনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে বলেই যে অ্যাসিড–সন্ত্রাস কমে গেছে এই যুক্তির আসলে কোনো ভিত্তি নেই।
তবে যেহেতু রাজপথের আন্দোলনের এই দাবিগুলো সরকারের নীতিনির্ধারণী কৌশলকে প্রভাবিত করতে পারে, প্রয়োজন এই প্রতিবাদের সঠিক লক্ষ্য এবং ভাষা নির্ধারণের। যুগ যুগ ধরে নারীরা ধর্ষণ আর যৌন অপরাধের শিকার হয়েছেন এবং অপরাধীরা পার পেয়ে চলেছে—অথচ সেই ইয়াসমিন হত্যার পর থেকে জনমনে একইভাবে নাড়া দিতে পারেনি আর অন্য কোনো ধর্ষণের ঘটনাই। আজকে যাঁরা ধর্ষণের ঘটনায় বিচলিত হয়ে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড চাইছেন, তাঁদের অনেকেই এত বছর প্রশ্ন করেছিলেন যে নারী নির্যাতনের জন্য এত আইন রয়েছে, পুরুষের জন্য নয় কেন? এই প্রশ্ন আর নারীর অভিযোগকে সন্দেহ করতে করতে যখন বনের বাঘ ঘরেই চলে আসার উপক্রম, তখনই হয়তো আমাদের সবার টনক নড়ল আর একেবারে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডকেই আমরা একমাত্র সমাধান দাবি করলাম।
শুধু মৃত্যুদণ্ড নয়, প্রতিবাদ হওয়া উচিত যুগ যুগ ধরে চলে আসা পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে, আর ধর্ষণের বিচারহীনতার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রকে এই প্রতিবাদের বিরোধীপক্ষ নয় বরং এই প্রতিবাদ আর আন্দোলনের মূল চালকের ভূমিকায় রাখতে হবে। প্রতিবাদের ভাষা যখন সুচিন্তিত, যুক্তিসংগত আর স্পষ্ট হবে, তখন রাষ্ট্রনীতিও ক্ষণস্থায়ী সমাধানের দিকে না গিয়ে সত্যিকার অর্থেই সমস্যার কার্যকর সমাধানের দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হবে।
তাসলিমা ইয়াসমিন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক।
Leave a Reply